ঢাকা ০৫:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
রাজশাহীতে আ.লীগের নেতাসহ বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার ১১ লালপুরে প্রেসক্লাবের নব-নির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটির শপথ গ্রহন বাগমারায় “উদীয়মান তরুণ সংঘের” উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ রাজশাহীর সাবেক এমপি আসাদের জামিন নামঞ্জুর ঝিনাইগাতীতে পৌণে ১ কোটি টাকার ভারতীয় শাড়ীসহ গ্রেফতার এক! বাগাতিপাড়ায় নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের এমডিকে অভিনন্দন জানিয়ে শোভাযাত্রা ফের সাজেক পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করলো জেলা প্রশাসন পুঠিয়ায় বিআরটিসি বাসের ধাক্কায় নারী ভ্যান আরোহী নিহত রাজশাহীতে পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার ২০ রাজশাহীতে বিভাগীয় কমিশনারের সাথে জামায়াত নেতৃবৃন্দের সৌজন্য সাক্ষাৎ

কীর্তিমান আব্দুর রাজ্জাকের বীরত্ব আজও মনে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের

এম এম মামুন, নিজস্ব প্রতিবেদক:
  • আপডেট সময় : ০৩:৩৮:৩৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ নভেম্বর ২০২৪ ৯৬ বার পড়া হয়েছে

collected

চ্যানেল এ নিউজ অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

কীর্তিমান আব্দুর রাজ্জাকের বীরত্ব আজও মনে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের বীরত্বগাথা অবদান আজও চোখে ভাসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। যুবকদের উদ্বুদ্ধ করে রনাঙ্গণে পাঠাতে তার নানামুখী পদক্ষেপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মুক্তিযোদ্ধারা। পেশায় শিক্ষক এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে সমাজের জনসাধারণের মাঝেও ছড়িয়েছেন দ্যুতি। ফলশ্রুতিতে জেলার বাইরেও ছড়িয়েছে তার সুখ্যাতি। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের বাসা রাজশাহীর তানোর উপজেলার তালন্দ গ্রামে। ১৯৪৪ সালের ১১ নভেম্বর তৎকালীন মালদহ জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে সদর উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের শিবিরের হাট এলাকা) পিরোজপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দেরাশতুল্লাহ মন্ডল-সাহেরা বিবি দম্পতির ৫ সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তার ভাই জালাল উদ্দিনও বীর মুক্তিযোদ্ধা। শিক্ষক হওয়ায় তিনি ‘রাজ্জাক মাস্টার’ নামে সুপরিচিত। তার এফএফ নম্বর ০১৮১০০০১৫৩৩ এবং লাল মুক্তিবার্তা নম্বর ০৩০২০৮০০০৫।

জানা গেছে, ১৯৬৬ সালে ছাত্রজীবন শেষে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে আব্দুর রাজ্জাক রাজশাহীর তানোরে এসে বসবাস শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এলাকায় তার সুখ্যাতি ছড়ায় অল্পদিনেই। ছাত্রজীবনের ধারাবাহিকতায় চাকুরী জীবনে এসে দেশের মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন, ‘৬৬-এর ছয় দফা, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচন- প্রতিটি ঘটনায় অতপ্রতভাবে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তানোর থেকে রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ গিয়ে নিজ জন্মস্থান সুন্দরপুর এলাকা থেকে ৫-৬ জনকে সাথে নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মালদহের জঙ্গিপুরের স্যাকারিপুরে যান। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা সন্তোষ মৈত্রের পরামর্শে পনুরায় দেশে ফিরে আসেন আরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের উদ্দেশ্য। এই দফায় তিনি আরো ২০-২২ জনকে সাথে নিয়ে গৌড়বাগান ইয়্যুথ ক্যাম্পে ভর্তি করিয়ে মুল ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়। গৌড়বাগান ক্যাম্পে অবস্থাকলীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যাওয়া তরুণ-যুবকদের উদ্বুদ্ধকরণে বক্তব্য ও প্রাথমিক ট্রেনিং প্রদান করতে থাকেন।

ওই সময়কার স্মৃতিচারণ করে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মে মাসে ১ম সপ্তাহে তানোর থেকে রাজশাহীতে গেলে গণি দারোগার সাথে দেখা হয়। গনি দারোগা আমাকে বলেন, ‘আপনি লিস্টেড, আপনি তিন নম্বরে আছেন। এক নম্বরে আছে মুন্ডুমালার মতিউর রহমান, তিনে আপনিসহ ১৭ জনা মোট।’ সেদিনই রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে যাই। সেখানেও আমার নাম কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার খবর পাই। সেদিন রাতেই গ্রামের বাড়ি গিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে নিজ ছোট ভাইসহ ৫-৬ জনকে নিয়ে ভারতে চলে যাই।’

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মে মাসের ৮/৯ তারিখ ভারত গেছি। শামসুল হুদা, হেলাল এরা সাথে গেছিল, লালগোলায় উঠলাম। রাতে না খায়্যা, দিনে না খায়্যা জোহরপুর বর্ডার দিয়্যা নৌকা চালায়ে গেলাম। আসরের সময় উঠলাম সেকারিপুরে। তার পরদিন গৌড়বাগান ক্যাম্পে গেলাম। বাচ্চু ডাক্তার ছিল, মইনুদ্দিন, মজিবুর এরা ছিল। সেখানে নাম লিখে নিল, আমার আন্ডারে ২০-২২ জন। আমাকে বলল, আপনি এডজুটেন্ট হয়ে থাকবেন। প্রায় ১৯০০ ছাইল্যা (ছেলে); ৩টা ভাগ করে। আমি একটাতে বক্তব্য রাখি, মইনুদ্দিন একটাতে বক্তব্য রাখে, ইংরেজির প্রফেসর ইবরাহিম আরেকটাতে। আবার মালদাহ ফিরে আসলাম। রাজশাহী থেকে যারা পালিয়ে আসলো তাদের আশ্রয় ও মোটামুটি ৪২ জনকে খাবার একসঙ্গে দিই। জানতে পারি, আদমপুর ক্যাম্পে আমাদের ১৮ জনকে শত্রুপক্ষ ভেবে আটকানো আছে, অরা গেছে, কিন্ত অরাকে খাইতে দেইনি আটকে রেখেছে। তারা এমএনএ‘র নাম বলতে পারছে না। তদের গিয়ে বাঁচাই।’

এলাকাবাসী জানান, তৎকালীন যুবকদের সংগ্রহ ও অনুপ্রেরণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল আব্দুর রাজ্জাকের। তাদেরই একজন তালন্দ এ.এম উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক প্রদীপ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, উনি আমাকে বলেন- ‘তুমি চলো; অসুবিধা নাই, ইয়াং ছেলে। ম্যালা (অনেক) বুঝনোর পর আমি রাজি হলাম। আমাকেসহ আরো অনেককে রিক্রুট করার জন্য মালদাহতে একটা হল রুম নিয়ে যায়। সেখানে রাজ্জাক সাহেব ছিলেন। উনি অর্গানাইজেশন করছেন, এটা আমি বুঝতে পারলাম। ছেলেদেরকে কালেকশন করছিলেন বিভিন্ন ক্যাম্পে, মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বুঝাচ্ছে, অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা কার্তিক চন্দ্র দাস বলেন, ‘উনি আমার শিক্ষাগুরু, একদিন দেখি আমাদের শরণার্থী ক্যাম্পে উনি এসেছেন আমাদের মত তরুণ ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করানোর জন্য, স্যারের অনুপ্রেরণায় প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৫ জন রাজি হলেও শেষ পর্যন্ত আমরা ৫/৬ জন ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করি।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের সুন্দরপুর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘উনার জন্মস্থান এখানে। এখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেছেন। কিন্তু কাগজকলম তানোরে। ৩০ বছর থেকে আমি ইউনিয়ন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছি, আগে ১৫ বছর করেছি। উনি (রাজ্জাক মাস্টার) আমাদের সিনিয়র। উনি ‘৭১-এ যুদ্ধ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাতে লিয়্যা (নিয়ে) যাওয়ার এলাকাতে তিনটা লোক। একটা রাজ্জাক মাস্টার, একটা মুনসুর ডাক্তার আর একটা শামসুল। আমি বাড়ি থাইক্যা গেছি মাত্র ৭টা টাকা লিয়্যা, বাপের পকেট থাইক্যা চুরি করে, তাও যাইতে যাইতে ঘাটাতে (রাস্তায়) কুনঠে (কোথায়) পইড়্যা (পড়ে) গেছে বুঝতে পারিনি। হামরাকে (আমাদের) লিয়্যা (নিয়ে) যাওয়া, ইন্ডিয়া পৌঁছা পর্যন্ত, খরচা-খরচ সব উনাদের।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন বলেন, ‘রাজ্জাক মাস্টার মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি একজন সফল সংগঠক। তিনি আমিসহ আমাদের এলকার প্রায় ৩০ জনকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সহয়তা করেছেন এবং সেখানে শিক্ষা দিয়েছেন।’ বীর মুক্তিযোদ্ধা হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘রাজ্জাক মাস্টার আমাকে সাথে করে ভারতে নিয়ে গেছে, নিয়ে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিয়েছে। উনি সংগঠক।’
তানোর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে উনি লোক পাঠিয়েছেন ট্রেনিং নেওয়ার জন্য। উনি আমার অনেক অনেক সিনিয়র ব্যক্তি। রাজ্জাক ভাই সম্মানীয় ব্যক্তি, এলাকার সব মানুষই তাকে সম্মান করে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘আব্দুর রাজ্জাক মাস্টার নামে তাকে চিনি। উনি শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, পাশাপাশি তাকে সংগঠকও বলা যায়। তার ভাই জালাল উদ্দিনও একজন মুক্তিযোদ্ধা, তারা দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা। আমি জানি, আব্দুর রাজ্জাক সাহেব গৌড় বাগান ক্যাম্পে অনেককে নিয়ে গেছেন। উনি গৌড় বাগান ক্যাম্পে গেছেন, ক্যাম্পে সুশৃঙ্খলভাবে রেখে এসেছেন। গুছিয়ে দিয়ে এসেছেন, সাহস-শক্তি জুগিয়েছেন। আবার উনি বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন, আবারও লোক নিয়ে গেছেন। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যেয়ে নিয়ে যেয়ে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।’

খাইরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য অনেক তার অবদান আছে। শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, দেশের জন্য বুঝিয়েছেন, স্বাধীনতা কী, স্বাধীনতা হলে কী সুবিধা আছে, আমরা কী অবস্থায় আছি। আমি মনে করি, তিনি বড় মাপের একজন সংগঠক এবং মুক্তিযোদ্ধা। উনি সম্মানিত শ্রদ্ধার ব্যক্তি।’

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

কীর্তিমান আব্দুর রাজ্জাকের বীরত্ব আজও মনে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের

আপডেট সময় : ০৩:৩৮:৩৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ নভেম্বর ২০২৪

কীর্তিমান আব্দুর রাজ্জাকের বীরত্ব আজও মনে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের বীরত্বগাথা অবদান আজও চোখে ভাসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। যুবকদের উদ্বুদ্ধ করে রনাঙ্গণে পাঠাতে তার নানামুখী পদক্ষেপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মুক্তিযোদ্ধারা। পেশায় শিক্ষক এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে সমাজের জনসাধারণের মাঝেও ছড়িয়েছেন দ্যুতি। ফলশ্রুতিতে জেলার বাইরেও ছড়িয়েছে তার সুখ্যাতি। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের বাসা রাজশাহীর তানোর উপজেলার তালন্দ গ্রামে। ১৯৪৪ সালের ১১ নভেম্বর তৎকালীন মালদহ জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে সদর উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের শিবিরের হাট এলাকা) পিরোজপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দেরাশতুল্লাহ মন্ডল-সাহেরা বিবি দম্পতির ৫ সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তার ভাই জালাল উদ্দিনও বীর মুক্তিযোদ্ধা। শিক্ষক হওয়ায় তিনি ‘রাজ্জাক মাস্টার’ নামে সুপরিচিত। তার এফএফ নম্বর ০১৮১০০০১৫৩৩ এবং লাল মুক্তিবার্তা নম্বর ০৩০২০৮০০০৫।

জানা গেছে, ১৯৬৬ সালে ছাত্রজীবন শেষে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে আব্দুর রাজ্জাক রাজশাহীর তানোরে এসে বসবাস শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এলাকায় তার সুখ্যাতি ছড়ায় অল্পদিনেই। ছাত্রজীবনের ধারাবাহিকতায় চাকুরী জীবনে এসে দেশের মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন, ‘৬৬-এর ছয় দফা, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচন- প্রতিটি ঘটনায় অতপ্রতভাবে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তানোর থেকে রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ গিয়ে নিজ জন্মস্থান সুন্দরপুর এলাকা থেকে ৫-৬ জনকে সাথে নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মালদহের জঙ্গিপুরের স্যাকারিপুরে যান। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা সন্তোষ মৈত্রের পরামর্শে পনুরায় দেশে ফিরে আসেন আরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের উদ্দেশ্য। এই দফায় তিনি আরো ২০-২২ জনকে সাথে নিয়ে গৌড়বাগান ইয়্যুথ ক্যাম্পে ভর্তি করিয়ে মুল ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়। গৌড়বাগান ক্যাম্পে অবস্থাকলীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যাওয়া তরুণ-যুবকদের উদ্বুদ্ধকরণে বক্তব্য ও প্রাথমিক ট্রেনিং প্রদান করতে থাকেন।

ওই সময়কার স্মৃতিচারণ করে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মে মাসে ১ম সপ্তাহে তানোর থেকে রাজশাহীতে গেলে গণি দারোগার সাথে দেখা হয়। গনি দারোগা আমাকে বলেন, ‘আপনি লিস্টেড, আপনি তিন নম্বরে আছেন। এক নম্বরে আছে মুন্ডুমালার মতিউর রহমান, তিনে আপনিসহ ১৭ জনা মোট।’ সেদিনই রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে যাই। সেখানেও আমার নাম কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার খবর পাই। সেদিন রাতেই গ্রামের বাড়ি গিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে নিজ ছোট ভাইসহ ৫-৬ জনকে নিয়ে ভারতে চলে যাই।’

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মে মাসের ৮/৯ তারিখ ভারত গেছি। শামসুল হুদা, হেলাল এরা সাথে গেছিল, লালগোলায় উঠলাম। রাতে না খায়্যা, দিনে না খায়্যা জোহরপুর বর্ডার দিয়্যা নৌকা চালায়ে গেলাম। আসরের সময় উঠলাম সেকারিপুরে। তার পরদিন গৌড়বাগান ক্যাম্পে গেলাম। বাচ্চু ডাক্তার ছিল, মইনুদ্দিন, মজিবুর এরা ছিল। সেখানে নাম লিখে নিল, আমার আন্ডারে ২০-২২ জন। আমাকে বলল, আপনি এডজুটেন্ট হয়ে থাকবেন। প্রায় ১৯০০ ছাইল্যা (ছেলে); ৩টা ভাগ করে। আমি একটাতে বক্তব্য রাখি, মইনুদ্দিন একটাতে বক্তব্য রাখে, ইংরেজির প্রফেসর ইবরাহিম আরেকটাতে। আবার মালদাহ ফিরে আসলাম। রাজশাহী থেকে যারা পালিয়ে আসলো তাদের আশ্রয় ও মোটামুটি ৪২ জনকে খাবার একসঙ্গে দিই। জানতে পারি, আদমপুর ক্যাম্পে আমাদের ১৮ জনকে শত্রুপক্ষ ভেবে আটকানো আছে, অরা গেছে, কিন্ত অরাকে খাইতে দেইনি আটকে রেখেছে। তারা এমএনএ‘র নাম বলতে পারছে না। তদের গিয়ে বাঁচাই।’

এলাকাবাসী জানান, তৎকালীন যুবকদের সংগ্রহ ও অনুপ্রেরণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল আব্দুর রাজ্জাকের। তাদেরই একজন তালন্দ এ.এম উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক প্রদীপ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, উনি আমাকে বলেন- ‘তুমি চলো; অসুবিধা নাই, ইয়াং ছেলে। ম্যালা (অনেক) বুঝনোর পর আমি রাজি হলাম। আমাকেসহ আরো অনেককে রিক্রুট করার জন্য মালদাহতে একটা হল রুম নিয়ে যায়। সেখানে রাজ্জাক সাহেব ছিলেন। উনি অর্গানাইজেশন করছেন, এটা আমি বুঝতে পারলাম। ছেলেদেরকে কালেকশন করছিলেন বিভিন্ন ক্যাম্পে, মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বুঝাচ্ছে, অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা কার্তিক চন্দ্র দাস বলেন, ‘উনি আমার শিক্ষাগুরু, একদিন দেখি আমাদের শরণার্থী ক্যাম্পে উনি এসেছেন আমাদের মত তরুণ ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করানোর জন্য, স্যারের অনুপ্রেরণায় প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৫ জন রাজি হলেও শেষ পর্যন্ত আমরা ৫/৬ জন ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করি।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের সুন্দরপুর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘উনার জন্মস্থান এখানে। এখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেছেন। কিন্তু কাগজকলম তানোরে। ৩০ বছর থেকে আমি ইউনিয়ন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছি, আগে ১৫ বছর করেছি। উনি (রাজ্জাক মাস্টার) আমাদের সিনিয়র। উনি ‘৭১-এ যুদ্ধ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাতে লিয়্যা (নিয়ে) যাওয়ার এলাকাতে তিনটা লোক। একটা রাজ্জাক মাস্টার, একটা মুনসুর ডাক্তার আর একটা শামসুল। আমি বাড়ি থাইক্যা গেছি মাত্র ৭টা টাকা লিয়্যা, বাপের পকেট থাইক্যা চুরি করে, তাও যাইতে যাইতে ঘাটাতে (রাস্তায়) কুনঠে (কোথায়) পইড়্যা (পড়ে) গেছে বুঝতে পারিনি। হামরাকে (আমাদের) লিয়্যা (নিয়ে) যাওয়া, ইন্ডিয়া পৌঁছা পর্যন্ত, খরচা-খরচ সব উনাদের।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন বলেন, ‘রাজ্জাক মাস্টার মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি একজন সফল সংগঠক। তিনি আমিসহ আমাদের এলকার প্রায় ৩০ জনকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সহয়তা করেছেন এবং সেখানে শিক্ষা দিয়েছেন।’ বীর মুক্তিযোদ্ধা হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘রাজ্জাক মাস্টার আমাকে সাথে করে ভারতে নিয়ে গেছে, নিয়ে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিয়েছে। উনি সংগঠক।’
তানোর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে উনি লোক পাঠিয়েছেন ট্রেনিং নেওয়ার জন্য। উনি আমার অনেক অনেক সিনিয়র ব্যক্তি। রাজ্জাক ভাই সম্মানীয় ব্যক্তি, এলাকার সব মানুষই তাকে সম্মান করে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘আব্দুর রাজ্জাক মাস্টার নামে তাকে চিনি। উনি শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, পাশাপাশি তাকে সংগঠকও বলা যায়। তার ভাই জালাল উদ্দিনও একজন মুক্তিযোদ্ধা, তারা দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা। আমি জানি, আব্দুর রাজ্জাক সাহেব গৌড় বাগান ক্যাম্পে অনেককে নিয়ে গেছেন। উনি গৌড় বাগান ক্যাম্পে গেছেন, ক্যাম্পে সুশৃঙ্খলভাবে রেখে এসেছেন। গুছিয়ে দিয়ে এসেছেন, সাহস-শক্তি জুগিয়েছেন। আবার উনি বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন, আবারও লোক নিয়ে গেছেন। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যেয়ে নিয়ে যেয়ে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।’

খাইরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য অনেক তার অবদান আছে। শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, দেশের জন্য বুঝিয়েছেন, স্বাধীনতা কী, স্বাধীনতা হলে কী সুবিধা আছে, আমরা কী অবস্থায় আছি। আমি মনে করি, তিনি বড় মাপের একজন সংগঠক এবং মুক্তিযোদ্ধা। উনি সম্মানিত শ্রদ্ধার ব্যক্তি।’